শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কট ও এর কারণসমূহ
শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে জনরোষ 2022 সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে তুঙ্গে পৌঁছায়। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থের অভাবে এই দ্বীপরাষ্ট্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে এবং তাঁর সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিবাদ এক গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। সারা দেশে গণবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে 1 এপ্রিল, 2022 শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। 3 এপ্রিল বিক্ষুব্ধ জনতা রাষ্ট্রপতির বাসভবন ঘিরে ফেলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে প্রাথমিকভাবে অনমনীয়তা দেখালেও মে মাসে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নিজের অগ্রজ মহিন্দা রাজাপক্ষেকে সরিয়ে দেন। এতেও জনবিক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে, কারফিউ ঘোষণা করে এবং ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটসঅ্যাপের মত সামাজিক মাধ্যমগুলির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেও জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে 13 জুলাই, 2022 দেশ থেকে পলায়ন করেন ও পরদিন রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংহে রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কট
- মে মাসে রানিল বিক্রমসিংহে প্রথমে যখন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন (অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বও তাঁর হাতে ন্যস্ত হয়), তখনই জানানো হয় যে তিনি
IMF-এর সঙ্গে ঋণ সংক্রান্ত আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন । - বিক্রমসিংহে ভারত, চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক ও বিশ্বব্যাঙ্কের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, সার ও ওষুধপত্রের প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য পরবর্তী ৪ মাসে 4 বিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয় ৷
- বিশ্বব্যাঙ্ক গত 24 মে একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে যতদিন পর্যন্ত না যথাযথ ম্যাক্রোইকনমিক পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে ওঠে ততদিন পর্যন্ত তারা নতুন করে ওই দেশকে অর্থ সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা করছে না।
- ইতিহাসে এই প্রথম দ্বীপরাষ্ট্রটি সুদের কিস্তি খেলাপির ফাঁদে পড়েছে। ওই দেশের দুটি ‘Sovereign bond’-এর সুদ প্রদানের 30 দিনের গ্রেস পিরিয়ড
শেষ হওয়ার পরেও ওই দেশ তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে। - শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সাবধান বার্তা দিয়ে বলেছে যে সেদেশের মুদ্রাস্ফীতি 40 শতাংশে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কটের কারণসমূহ
ঋণের ফাঁদের’কূটনীতি – অভিযোগ রয়েছে যে চিন শ্রীলঙ্কাকে পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পের (হামবানটোটা বন্দর) জন্য যে ঋণ দিয়েছে তা শ্রীলঙ্কা সরকার পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পর্যটন শিল্পের পতন – কোভিড-19 অতিমারির ও 2019 সালের ইস্টারের সময়কালীন বোমা বিস্ফোরণের জেরে সেদেশের পর্যটন শিল্পের রাজস্বের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনটি প্রধান দেশ – ভারত, রাশিয়া ও ব্রিটেন থেকে শ্রীলঙ্কায় পর্যটকদের যাতায়াত হ্রাস পাওয়ায় সে দেশের পর্যটন সংক্রান্ত আয় 2018 সালের 4.4 বিলিয়ন ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে 2019 সালে মাত্র 506.9 মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পর্যটন শ্রীলঙ্কার তৃতীয় সর্ববৃহৎ বিদেশী মুদ্রার উৎস ।
বৈদেশিক ঋণ খেলাপি – শ্রীলঙ্কার দুর্বল অর্থনীতি পরিচালনার জেরে সে দেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয় ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। 1948 সালে স্বাধীনতা
লাভের পরে সেদেশের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক সঙ্কট এবারই দেখা দিয়েছে। ওই দেশের 51 বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক ঋণ খেলাপি থেকেই এই সঙ্কটের শুরু। শ্রীলঙ্কা খাদ্যদ্রব্য বিশেষতঃ চিনি, ডাল ও দানা শস্যের আমদানির উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল, এগুলির জরুরি আমদানির জেরে ওই দেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয় আরও হ্রাস পায়। এছাড়া অতিরিক্ত কর ছাড়ের ফলেও সেদেশের সরকারি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস পায়। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।
কৃষিসংক্রান্ত সঙ্কট – 2020 সালে সেদেশের অর্থনীতি প্রচন্ড সঙ্কটের মুখে পড়ে যখন শ্রীলঙ্কা সরকার কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এবং পরিবর্তে একশো শতাংশ অর্গানিক ফার্মিংয়ের (জৈব চাষ) উপর জোর দেয়। এর জেরে মূলতঃ চাল ও চিনির উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশের চাষীরা জৈব চাষের জন্য পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত ছিলেন না যার জেরে কৃষি উৎপাদন মার খায়। সরকার অবশ্য 2021 সালের নভেম্বর মাসে রাসায়নিক সারের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু তখন ক্ষতি যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। সেদেশের খাদ্য নিরাপত্তা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে।
যুদ্ধ সংক্রান্ত মুদ্রাস্ফীতি – চলতি রুশ-ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে অপরিশোধিত তেল ও সানফ্লাওয়ার অয়েলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। গত 14
বছরে এই প্রথম অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপিছু 125 ডলারে পৌঁছে যায়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে 2022 সালের মার্চ মাসে দেশের ‘headline inflation’ 18.7 শতাংশ ও খাদ্যসংক্রান্ত মূল্যবৃদ্ধি 30.2 পৌঁছে যায় ৷
FDI-এর পতন – 2019 সালে শ্রীলঙ্কায় FDI এর পরিমাণ ছিল 793 মিলিয়ন ডলার এবং 2018 সালে FDI ছিল 1.6 বিলিয়ন ডলার। 2020 সালে FDI বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে হয় 548 মিলিয়ন ডলার।
দুর্বল মুদ্রাব্যবস্থা – 2022 সালে শ্রীলঙ্কার টাকার মূল্যমান মার্কিন ডলারের তুলনায় 50 শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং ভারতীয় টাকার তুলনায় তা 31.6
শতাংশ হ্রাস পেয়েছে ।
ভারতের উপর প্রতিক্রিয়া
উদ্বাস্তু সঙ্কট – ভারতের নির্দিষ্ট কোন সর্বাত্মক উদ্বাস্তু নীতি না থাকার জন্য এদেশে প্রচুর পরিমাণে উদ্বাস্তু সমাগম হলে যোগানের ক্ষেত্রে সমস্যা ও শ্রমের বাজারে প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। যদি উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে যথাযথ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না হয় তাহলে এর জেরে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে . এবং সেক্ষেত্রে সরকারি/বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে চাপের সৃষ্টি হতে পারে। এর জেরে সামাজিক পরিষেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে পারে।.
চিনের প্রভাব – শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই চিনের কাছে 2.50 বিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তার আবেদন করছে। এর ফলে দ্বীপরাষ্ট্রে চিনের সামরিক ও
রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাণিজ্যের উপর প্রভাব – ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য কলম্বো বন্দরের উপর নির্ভরশীল যা একটি trans-shipment hub। যদি কলম্বো বন্দরের
কাজকর্ম বিঘ্নিত হয় তাহলে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধি ও ট্রাফিক সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। শ্রীলঙ্কায় ভারতের রফতানি বাণিজ্যের উপর বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও স্পট ট্রেডিং প্রভাব বিস্তার করতে পারে ৷
বিদ্রোহী সংগঠনগুলির উত্থান – দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে সিংহলী জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে অতীতের মাওবাদী সংগঠন জনতা বিমুক্তি পেরামুনা বা তামিল ইলমের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের উত্থান ঘটতে পারে এবং ওই দেশে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।
বিনিয়োগ — শ্রীলঙ্কার এই বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে সেদেশে বেশ কিছু ভারতীয় কোম্পানির অপারেশন ও বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৷ এই সব কোম্পানিগুলির মধ্যে রয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল, এয়ারটেল ও টাটা কমিউনিকেশনস্-এর মত সংস্থাগুলি। এর জেরে এইসব কোম্পানির রাজস্বের
উপর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হতে পারে যা ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।
.