গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস
- বৌদ্ধধর্মের মূল স্তম্ভ হল— বুদ্ধ, ধর্ম এবং সঙ্ঘ।
- বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সুত্তনিপাত, অশ্বঘোষ রচিত বুদ্ধচরিত, সিংহলী গ্রন্থ মহাবংশ ও দীপবংশ, জাতক কাহিনী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে জানতে পারি।
গৌতম বুদ্ধ
- জন্ম সময়— 563 BC (আনুমানিক)
- জন্মস্থান— লুম্বিনি (কপিলাবস্তুর কাছে)
- পিতা— শুদ্ধোধন (শাক্য বংশীয় রাজা)
- মাতা— মায়া দেবী (বুদ্ধের জন্মের 7 দিন পরে মারা যান)
- বিমাতা— মহাপ্রজাপতি গৌতমী
- বাল্য নাম— সিদ্ধার্থ
- স্ত্রী— গোপা (মতান্তরে যশোধরা)
- পুত্র— রাহুল,
- ঘোড়া— কণ্টক
- সারথি— চান্না
- মহাভিনিষ্ক্রমণ বা গৃহত্যাগ 29 বছর বয়সে
- সিদ্ধিলাভ 35 বছর বয়সে, উরুবিল্ল. (বর্তমানে বুদ্ধগয়া) নামক স্থানে, অশ্বত্থ (পিপল) গাছের তলায়, নীরঞ্জনা নদীর তীরে। 48 দিন (মতান্তরে এক মাস) ধ্যানমগ্ন থাকার পর দিব্যজ্ঞান বা সিদ্ধিলাভ করেন।
- ধর্মচক্র প্রবর্তন— বুদ্ধত্ব লাভের পর কাশীর নিকটবর্তী ঋষিপত্তনের (বর্তমানে সারনাথ) মৃগদাব বনে বুদ্ধদেব পঞ্চভিক্ষুদের (ভদ্রিক, অশ্বজিৎ, মহানাম, বাষ্প, কৌন্ডিণ্য) প্রথম ধর্মোপদেশ দান করেন। এই ঘটনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ নামে খ্যাত।
- সমসাময়িক মগধের রাজা— বিম্বিসার
- বুদ্ধের প্রথম দু’জন গুরু— আলারা কালমা ও রুদ্দক রামপুত্ত।
- জন্ম, মৃত্যু এবং গৃহত্যাগ— এই তিনটিই ঘটেছিল বৈশাখী পূর্ণিমার দিন।
- বুদ্ধ সবচেয়ে বেশি বাণী প্রচার করেন শ্রাবস্তীতে।
- গৌতম বুদ্ধকে ধ্যান এবং উপনিষদ সম্পর্কে শিক্ষা দেন— আলারা কালমা ।
- যে-চারটি দৃশ্য গৌতমের হৃদয়ে বেদনার সৃষ্টি করেছিল, যার কারণে গৃহত্যাগ করেছিলেন, তা হল:
- (ক) একজন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ
- (খ) একজন অসুস্থ মানুষ
- (গ) একটি মৃহদেহ
- (ঘ) একজন ধার্মিক ভিক্ষু (সন্ন্যাসী)
- গৌতম বুদ্ধ আট মাস নানা স্থানে ভ্রমণ করে ধর্মপ্রচার করতেন এবং বর্ষার চার মাস কাটাতেন শিষ্যদের কাছ থেকে পাওয়া কোনও উদ্যানের পর্ণকুটিরে।
- দেহত্যাগের সময় গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য ছিলেন আনন্দ।
বৌদ্ধধর্মের নীতিসমূহ
আর্যসত্য
বৌদ্ধধর্মের সারমর্ম নিহিত রয়েছে চারটি সত্যের মধ্যে । এগুলি হল—
- জগৎ দুঃখময়
- কামনা-বাসনা ও আসক্তিই হল দুঃখের কারণ
- দুঃখ-কষ্ট নিবারণের উপায় আছে
- দুঃখ-কষ্টের অবসানের জন্য সত্য পথ অনুসরণ করতে হবে ।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ
পার্থিব ভোগ-তৃষ্ণা থেকেই দুঃখের জন্ম এবং তৃষ্ণাই মুক্তির পরিবর্তে জন্মান্তর ঘটায়। সুতরাং পার্থিব তৃষ্ণার অবসানের জন্য তিনি আটটি পথ বা
অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলি হল-
- সৎ-সংকল্প
- সৎ-চিন্তা
- সৎ বাক্য
- সৎ ব্যবহার
- সৎ জীবনযাপন
- সৎ প্রচেষ্টা
- সৎ দৃষ্টি
- সম্যক সমাধি ।
মধ্যপন্থা: চরম ভোগবিলাস ও বিষয়-আশয়ের প্রতি আসক্তি এবং চরম কৃচ্ছ্রসাধন, এই দুই-ই আত্মার উন্নতির পথে বিঘ্নস্বরূপ। তাই এই দুই পন্থা ত্যাগ করে এর মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করাকেই তিনি মধ্যপন্থা বলেছেন।
পঞ্চশীল: অহিংসা, সত্যবাদিতা, অচৌর্য, অন্যায় না করা, অসদাচরণ পরিহার করা।
বৌদ্ধ মহাসম্মেলন
প্রথম মহাসম্মেলন
- সময় — 483 খ্রিস্টপূর্ব (মতান্তরে 487 খ্রিস্টপূর্ব)
- স্থান— শতপর্ণী গুহা, রাজগৃহ
- সভাপতি— মহাকাশ্যপ
- সমসাময়িক শাসক— অজাতশত্রু (হর্ষঙ্ক বংশ)
- উদ্দেশ্য— বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থাবলি সংকলিত করা
দ্বিতীয় মহাসম্মেলন
- স্থান— উত্তর ভারতের বৈশালী
- সময়— 387 খ্রিস্টপূর্ব (মতান্তরে 383 খ্রিস্টপূর্ব)
- সভাপতি— সবকামী
- সমসাময়িক শাসক— কালাশোক (শিশুনাগ বংশ)
- উদ্দেশ্য— থেরবাদী ও মহাসঙ্ঘিকা নামে দু’টি সম্প্রদায় ও সর্বস্তিবাদী নামক উপসম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের মধ্যে যে বিরোধ দেখা দেয়, তা নিরসনের জন্য এই সম্মেলন আহূত হয় ।
তৃতীয় মহাসম্মেলন
- স্থান— পাটলিপুত্র
- সময়— 237 বা 250 খ্রিস্টপূর্বাব্দ
- সভাপতি— সংখলিপুত্ত তিস্য
- সমসাময়িক শাসক – অশোক (মৌর্য বংশ )
- উদ্দেশ্য— ধর্মশাস্ত্রগুলির সংশোধন।
চতুর্থ মহাসম্মেলন
- স্থান— কাশ্মীর (জলন্ধর)
- সময়— 72 খ্রিস্টপূর্বাব্দ
- সভাপতি— বসুমিত্র
- সমসাময়িক শাসক – কণিষ্ক (কুষাণ বংশ)
- উদ্দেশ্য— ত্রুটিযুক্ত মতবাদগুলির সংশোধন। এই সময় বৌদ্ধরা হীনযান এবং মহাযান, দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক
অশোক, কণিষ্ক, ধর্মপাল, উদয়ন, কুজল কদফিসেস, মিনান্দার, হর্ষ প্রমুখ ।
বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সংশিষ্ট প্রতীক
বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠী
- থেরাবাদী বা স্থবিরবাদী:
- এর উৎপত্তি হয়েছিল দ্বিতীয় মহাসম্মেলনে।
- এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন— মহাকাচ্চায়ন ।
- এর প্রধান কেন্দ্র ছিল— কৌশাম্বি, উজ্জয়িনী। গৃহীত ভাষা— পালি।
- সর্বাস্তিবাদী:
- ‘সর্বম অস্তি’ – এই নীতিতে বিশ্বাসী।
- এর প্রতিষ্ঠাতা রাহুল ভদ্র।
- কুষাণ যুগে চিনে বিস্তার লাভ করে।
- বৈভাষিক:
- সর্বাস্তিবাদ থেকে এর জন্ম।
- প্রধান কেন্দ্র, কাশ্মীর এবং গান্ধার।
- বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের টিপ্পনিমূলক রচনাবলি এঁদের সৃষ্টি।
- সৌত্রান্তিক:
- সর্বাস্তিবাদ বা বৈভাষিকদের বিরুদ্ধ পক্ষ।
- এঁরা মূল সূত্র বা বিনয়গুলির উপর নির্ভর করতেন।
- অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, কুমারলাট এবং আর্যদেব ছিলেন সৌত্রান্তিক।
- মহাসংঘিকা :
- দ্বিতীয় মহাসম্মেলনে জন্মলাভ।
- এর প্রতিষ্ঠাতা মহাকাশ্যপ।
- প্রাকৃত ভাষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল।
- এর প্রধান কেন্দ্র ছিল মগধ এবং বৈশালী।
- মহাযান:
- মহাযান শব্দের অর্থ, মহৎবাহন বা পথ।
- উদার মতাবলম্বী বৌদ্ধরা মহাযান নামে পরিচিত।
- এরা বুদ্ধদেবের মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী।
- এঁরা সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতেন।
- ত্রিকায়া মতবাদে বিশ্বাসী।
- বৌধিসত্ত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
- বর্তমানে মহাযান পন্থার চর্চা দেখা যায়— চিন, জাপান, ভারত, কোরিয়া ও নেপালে।
- এই মতবাদের দু’টি ধারা হল— মাধ্যমিক, যোগাচার।
- হীনযান:
- হীনযান শব্দের অর্থ— লঘুতর বাহন বা পথ।
- গোঁড়া বৌদ্ধরা হীনযান নামে পরিচিত।
- এঁদের গৃহীত ভাষা পালি।
- আত্ম-নিয়মানুবর্তিতা এবং ধ্যানের মধ্য দিয়ে মোক্ষলাভ সম্ভব— এই নীতিতে বিশ্বাসী।
- এরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করেন না।
- হীনযানরা মূলত শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে।
- বজ্রযান:
- অতিপ্রাকৃত উপাদান হিসাবে বজ্রকে গ্রহণ করে।
- প্রাচীনতম গ্রন্থ মঞ্জুশ্রী মূলকল্প।
- জাদুকরী শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়েই মোক্ষলাভ সম্ভব বলে এঁরা মনে করেন।
- নারীদেবতা তারা তাঁদের উপাস্য।
- পবিত্র মন্ত্র— ‘ওম মণি পদ্মে হুঁ।’
বৌদ্ধ সংঘ
- গৌতম বুদ্ধের দু-রকমের শিষ্য ছিলেন— ভিক্ষু বা শ্রমণ এবং উপাসক।
- বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হল সঙ্ঘ।
- বুদ্ধের রাজন্যবর্গ, শ্রেষ্ঠী ও বণিকদের অর্থানুকূল্যে সঙ্ঘ স্থাপিত হয়েছিল।
- সঙ্ঘে জাতপাতের কোনও বাছবিচার ছিল না।
- মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো ছিল সঙ্ঘের একটি উদ্দেশ্য।
- গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসারে সঙ্ঘগুলি পরিচালিত হত।
- পথভ্রষ্ট সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার সঙ্ঘের ছিল।
- বৌদ্ধ সঙ্ঘের প্রাথমিক অনুষ্ঠান ‘প্রব্রজ্যা’ নামে পরিচিত।
- আট বছর বয়স না হলে প্রব্রজ্যা নেওয়া যায় না।
- ভিক্ষুদের পরিধান ছিল পীত বর্ণের তিন টুকরো বস্ত্র- উর্ধ্বাঙ্গ, নিম্নাঙ্গের বস্ত্র এবং উত্তরীয় ।
- প্রতিমোক্ষ: বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সঙ্ঘজীবনের নিয়মাবলি লঙ্ঘন করলে শাস্তিদানের ব্যবস্থা ছিল যা প্রতিমোক্ষ নামে পরিচিত।
- অপরাধী, কুষ্ঠরোগী এবং সংক্রামক ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের সঙ্ঘে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
- সঙ্ঘের নবীন ভিক্ষুণীরা ‘শিক্ষামানা’ নামে পরিচিত ছিলেন।
- সঙ্ঘের প্রথম নারী সদস্য ছিলেন গৌতমী ।
- বর্তমানে সঙ্ঘ বিস্তার লাভ করেছে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডে।
- সদস্যদের কঠোর অনুশাসনের মধ্য দিয়ে চলতে হত।