আজকে আমরা আলোচনা করবো ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে। আমরা দেখে নেবো মালভূমি কাকে বলে ? মালভূমির বৈশিষ্ট্য কি ? মালভূমির অপর নাম কি ? বিভিন্ন প্রকার মালভূমির উদাহরণ , সাথে দেখে নেবো ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মালভুমি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য । যেমন – একটি পর্বত বেষ্টিত মালভূমির নাম লেখ । ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি কাকে বলে প্রভৃতি ।
Table of Contents
মালভূমি কাকে বলে ?
এক বিশেষ ধরনের ঊচ্চভূমি যা বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছে। এর উপরিভাগ মৃদু তরঙ্গায়িত। চারপাশ খাড়া ঢালযুক্ত এবং কঠিন আগ্নেয়শিলা ও রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত।
মালভূমিকে ‘টেবিল ল্যান্ড‘ হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে, কারণ এর চারপাশ খাড়া ঢালযুক্ত ও উপরের অংশ মৃদু ঢেউ খেলানো হওয়ায় দূর থেকে এটিকে দেখতে অনেকটা টেবিলের মত হয়। মালভূমির অপর নাম ‘টেবিল ল্যান্ড‘ ।
মালভূমির বৈশিষ্ট্য
- বিস্তীর্ণ উচ্চভূমির উচ্চতা গড়ে ৩০০ মিটারের বেশি,
- অবস্থানভেদে এর উচ্চতা, গঠন, প্রকৃতির পার্থক্য হয়ে থাকে,
- এটি খাড়া ঢালযুক্ত হয়,
- উপরিভাগ ঢেউ খেলানো হয়।
মালভূমি সৃষ্টির কারণ
বিভিন্ন কারণে মালভূমি সৃষ্টি হতে পারে যথা—
- পাত সঞ্চালনের ফলে
- চ্যুতির ফলে
- লাভা সঞ্চয়ের ফলে ।
দেখে নাও : পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল সম্বন্ধে প্রশ্ন ও উত্তর
মালভূমির প্রকারভেদ
উৎপত্তি অনুসারে মালভূমিকে চারভাগে ভাগ করা যায়, যথা—
- ভূ-আলোড়নের ফলে গঠিত মালভূমি,
- ক্ষয়ের ফলে গঠিত মালভূমি,
- আগ্নেয় বা সঞ্চয়জাত মালভূমি;
- অন্যান্য মালভূমি।
ভূ-আলোড়নের ফলে গঠিত মালভূমিকে আবার চারভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- ১। পর্বতবেষ্টিত মালভূমি,
- ২। মহাদেশীয় মালভূমি বা শিল্ড মালভূমি,
- ৩। তির্যক মালভূমি,
- ৪। চ্যুতির ফলে সৃষ্ট মালভূমি।
ক্ষয়ের ফলে গঠিত মালভূমিকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- ১। ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি,
- ২। ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি এবং
- ৩। সম মালভূমি ।
অন্যান্য মালভূমির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- ১। পাদদেশীয় মালভূমি,
২। মরু মালভূমি এবং - ৩। তুষার মালভূমি।
পর্বতবেষ্টিত মালভূমি :- যে মালভূমিগুলি পর্বত দ্বারা বেষ্টিত তা পর্বতবেষ্টিত মালভূমি নামে পরিচিত। উদাহরণ- পামির মালভূমি, তিব্বত মালভূমি প্রভৃতি ।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি :- কঠিন এবং নরম শিলা দ্বারা গঠিত উচ্চভূমিভাগ দীর্ঘদিন ধরে নগ্নীভবন প্রক্রিয়ায় নরম শিলাস্তর ক্ষয় পেয়ে এবং নদীর উপত্যকা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যে মালভূমি গঠিত হয়, তাকেই ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি বলা হয়।
উদাহরণ- ছোটনাগপুরের হাজারিবাগ মালভূমি, কর্ণাটকের মালনাদ মালভূমি প্রভৃতি।
লাভা মালভূমি :- অগ্নৎগমের ফলে ভূ-অভ্যন্তরীণ ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ ঠান্ডা ও কঠিন হয়ে এই মালভূমি গঠন করে। উদাহরণ— ডেকান ট্রাপ বা দাক্ষিণাত্য মালভূমি ।
মহাদেশীয় মালভূমি :- যে সকল মালভূমির আয়তন মহাদেশের সমান, তাদের মহাদেশীয় মালভূমি বলা হয়। উদাহরণ- আন্টার্কটিকা মালভূমি, সাইবেরিয়া মালভূমি প্রভৃতি।
ক্ষয়জাত মালভূমি :- কোনো উচ্চভূমি অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মালভূমির আকার ধারণ করে, তখন সেই মালভূমিকে বলা হয় ক্ষয়জাত মালভূমি। উদাহরণ- ফিজেল্ড মালভূমি ।
মালভূমির গুরুত্ব
- (১) খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার,
- (২) মালভূমির খরস্রোতা নদীনগুলি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়,
- (৩) পর্যটন শিল্পের বিস্তার,
- (৪) মনোরম জলবায়ু অঞ্চল,
- (৫) খনিজভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে।
ভারতের বিভিন্ন মালভূমি
ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মালভূমির তথ্য নিচে দেওয়া রইলো ।
লাদাখ মালভূমি :- কারাকোরাম পর্বত শ্রেণি ও কাশ্মীর হিমালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ৩৫০ কিমি দীর্ঘ অঞ্চল নিয়ে এই মালভূমি গঠিত। এটি ভারতের সর্বোচ্চ মালভূমি, ইহা শীতল মরুভূমি নামেও পরিচিত।
মেঘালয় মালভূমি :- মেঘালয় রাজ্যের গারো, খাসিয়া, জয়ন্তিয়া, মিকির প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে এই মালভূমি গঠিত হয়েছে। মেঘালয় মালভূমির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল শিলং পাহাড় যা খাসি পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। গারো পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল নকরেখ এবং মিকির পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল ডাম্বুজকো। শিলং পাহাড়ের দক্ষিণে অবস্থিত চেরা মালভূমিতে বহু চুনাপাথরের গুহা দেখা যায় ।
দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল:- ইহা মূলত লাভা মালভূমি।
নিম্নলিখিত অঞ্চলগুলি নিয়ে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল গঠিত, যথা—
- পশ্চিমঘাট বা সহ্যাদ্রি পর্বত:- এর পশ্চিম ঢাল আরব সাগরের দিকে এবং খুব খাড়া হলেও পূর্ব ঢাল মৃদু প্রকৃতির। এটি একটি তির্যকচ্যুত স্তুপ পর্বত। উপদ্বীপীয় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি, যেমন— গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরি এই অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। আনাইমুদি হল পশ্চিমঘাট পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভারতের অন্যতম জলপ্রপাত যোগ বা মহাত্মা গান্ধী জলপ্রপাত এই অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গিরিপথ হল থলঘাট, ভোরঘাট ও পালঘাট।
- পূর্বঘাট বা মলয়াদ্রি পর্বত:- গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এটি অবস্থিত। জিঙ্গাদা শৃঙ্গ হল পূর্বঘাট পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গোদাবরী, কৃষ্ণা, পেন্নার প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
- সাতপুরা পর্বত :— এটি একটি স্তুপ পর্বত। এর দুপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নর্মদা ও তাপ্তি নদী। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল ধূপগড় ।
- মহারাষ্ট্র মালভূমি :- লাভা গঠিত মালভূমি। সমগ্র অঞ্চলটি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে নেমে গেছে, তাই এই মালভূমিকে ডেকান ট্রাপ বলে।
- কর্ণাটক মালভূমি :— এটি মালনাদ নামে পরিচিত। এটি মূলত এক ধরনের ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি ।
- ছোটনাগপুর মালভূমি :- সমগ্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশের অংশবিশেষ নিয়ে এই মালভূমি গঠিত। ছোটনাগপুর মালভূমির পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নেতারহাট অঞ্চল এই মালভূমির সবচেয়ে উঁচু স্থান, এটি প্যাট অঞ্চল নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল পরেশনাথ।
- বাঘেলখণ্ড মালভূমি :- ছোটনাগপুর মালভূমির পশ্চিমে শোন নদী উপত্যকার দক্ষিণে এই মালভূমি অবস্থিত।
- তেলেঙ্গানা মালভূমি :—কর্ণাটক মালভূমির পূর্ব প্রান্তে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা রাজ্যের অংশবিশেষ নিয়ে এই মালভূমি গঠিত হয়েছে।