পেগাসাস : ব্যক্তিস্বাধীনতার চরম শত্রু
বর্তমানে পেগাসাস নিয়ে উত্তাল ভারতীয় রাজনীতি। সম্প্রতি ভারতের ৪০ জন সাংবাদিক, বিশিষ্ট কিছু পরিবেশ কর্মী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনে পেগাসাসের মাধ্যমে নজরদারির ঘটনা সামনে এসেছে। ‘গার্ডিয়ান’ (Guardian) এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে মোট ১০ টি দেশের সরকার নাগরিকদের উপর নজরদারি চালাচ্ছে, যার মধ্যে ভারতও রয়েছে। এই রিপোর্ট সামনে আসার পরই সরগরম হয়ে ওঠে সংসদের বাদল অধিবেশন। সচেতন নাগরিক মাত্রই পেগাসাসকে একবিংশ শতকে ব্যক্তিস্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করছেন। কিন্তু কী এই পেগাসাস ? এর উৎপত্তি বা কোথায় ? পেগাসাস শব্দটির উৎসই বা কী ? আমজনতার মনে উঁকি মারছে এমনই হাজারো প্রশ্ন।
পেগাসাস শব্দটি এসেছে গ্রীক পুরাণ থেকে। গ্রীক পুরাণে পেগাসাসের নাম উচ্চারিত হয় ভক্তির সাথে। গ্রীক দেবতা জিউসের পক্ষ্মীরাজ ঘোড়ার নাম ছিল পেগাসাস। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী জিউস তাঁর প্রিয় পক্ষ্মীরাজকে সসম্মানে নক্ষত্রমন্ডলে স্থান দেন।
কিন্তু একবিংশ শতকের পেগাসাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি নজরদারির কাজে ব্যবহৃত একটি স্পাইওয়্যার। ভয়ংকর এই স্পাইওয়্যার তৈরির নেপথ্যে রয়েছে ইজরায়েলের সংস্থা NSO। এই স্পাইওয়্যারের সংবাদ প্রথম সামনে আসে ২০১৬ সালে। হ্যাকিং ক্ষমতার কারণেই এটি উঠে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পেগাসাস সম্পর্কে জনপ্রিয় অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানি ক্যাসপারস্কাই ২০১৭ সালে লিখেছিল, একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমরা সম্পূর্ণ পেগাসাসের নজরদারির মধ্যে আছি। যা ফোনে প্রবেশ করলে ব্যবহারকারী কোনো ভাবেই বুঝতে পারবেন না, তার ফোন হ্যাক হয়ে গেছে। একবার কোনো ফোনে এটি ইনস্টল হলে সেই ফোনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই স্পাইওয়্যার। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপের মতো এনক্রিপ্টেড চ্যাটও পড়তে পারবে এই স্পাইওয়্যার। মেসেজ পড়া ছাড়াও কল ট্র্যাক, গ্রাহকের অ্যাপের বিশদ বিবরণ, লোকেশন ডেটা সমস্ত কিছুই অ্যাকসেস করতে পারবে পেগাসাস। ফোনের ভিডিও ক্যামেরা চালু করে সেই ভিডিও দেখতে পারে এই স্পাইওয়্যার। অর্থাৎ ফোন ব্যবহারকারীর কাছে থাকলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে পেগাসাসের হাতে। এক কথায় এটি একটি চূড়ান্ত নজরদারি ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে এটি আরোও উন্নত হয়েছে। শুরুর দিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট লিংকে ক্লিক করলে তবেই কারো ফোনে এই স্পাইওয়্যার প্রবেশ করতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো লিংকের। কোনো ক্লিক ছাড়াই এই স্পাইওয়্যার ইনস্টল হয়ে যাচ্ছে যেকোনো স্মার্ট ফোনে। আর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই পেগাসাসকে বলা হয় ‘জিরো ক্লিক স্পাইওয়্যার‘।
ইজরায়েলি সংস্থা NSO মূলত এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে থাকে বিভিন্ন দেশের সরকারকে। NSO এর মুখপাত্রের মতে, বিক্রির পর পেগাসাসের নিয়ন্ত্রণ থাকে না কোম্পানির হাতে। তাই এর অপব্যাবহারের দায় কোম্পানির নয়। ইজরায়েলি এই সংস্থা দেশের সুরক্ষার কারণেই তৈরি করে এই হ্যাকিং সিস্টেমটি। মূলত সন্ত্রাসবাদ রুখতে এবং সন্ত্রাসবাদীদের গতিবিধি নজরে রাখতে এটি তৈরি করা হয়। বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে মেক্সিকো প্রথম ইজরায়েলের কাছ থেকে এই হ্যাকিং সিস্টেমটি ক্রয় করে। এটি ব্যবহার করে মেক্সিকো সরকার ২০১৬ সালে ৮ ই জানুয়ারি কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া এল চ্যাপোকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সরকার সে দেশের সাংবাদিকদের উপর নজরদারি চালাতেও এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার শুরু করে। ২০১৮ সালে কানাডার সিটিজেন ল্যাবের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ৪৫টি দেশের সরকার পেগাসাস ব্যবহার করছে। ২০১৯ সালে ফেসবুকের পক্ষ থেকে সমস্ত ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের সতর্ক করা হয় পেগাসাস সম্পর্কে। ওই বছরই ফেসবুক তার গ্রাহকদের উপর নজরদারি চালানোর অপরাধে মামলা দায়ের করে পেগাসাসের বিরূদ্ধে। অতিসম্প্রতি ফ্রান্সও পেগাসাসের বিরূদ্ধে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনীতিকদের উপর পেগাসাসের মাধ্যমে যেভাবে গ্লোবাল নজরদারি চালানো হচ্ছে তা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর চরমতম আক্রমণ। স্বাধীন বিশ্বে যা মোটেই কাঙ্খিত নয়। NSO কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তাদের মতামত জানাতে গিয়ে বলেছেন, তারা কখনোই ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন না। তাদের মূল লক্ষ্য বিশ্বকে সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু কোনো কারণে এই প্রযুক্তি যদি বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করার কাজে ব্যবহৃত হয় তবে কোম্পানি এই প্রযুক্তি বন্ধ করার পূর্বে দ্বিতীয়বার ভাববে না।
তথ্যসূত্র : চেষ্টা